আসামে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি-প্রসঙ্গ ১৯৪৭-১৯৬১

সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকায় অভি বিরাট স্রোত শুরু হয়। তিন শতাব্দীরও অধিক সময়সীমার মধ্যে এই অভিগমনের মাত্রা ধীর গতিতে আসা মাত্র কয়েকশ ইংরেজ উপনিবেশ বাদী থেকে বেড়ে বন্যার বেগে আসা নবাগতদের সংখ্যা লক্ষে লক্ষে পরিণত হয়। শক্তিশালী ও বিভিন্ন ধরনের প্রেরণ য় উদ্দীপিত এই নবাগতরা এক সময়কার বর্বর এই মহাদেশে নতুন এক সভ্যতা গড়ে তোলে। মেক্সিকো, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং দক্ষিণ আমেরিকায় স্পেনের বর্ধিষ্ণু উপনিবেশ স্থাপিত হওয়ার অনেক পর যে ভূখণ্ড এখন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করে প্রথম ইংরেজ অভিবাসীরা পদার্পণ করে। এই নতুন দেশের প্রথম সফরকারীদের মত তারাও জনাকীর্ণ ছোট ছোট জাহাজে চড়ে এসেছিলো । ছয় থেকে বারো সপ্তাহ ব্যাপী সমুদ্রযাত্রায় তাদেরকে স্বল্প পরিমাণ খাদ্য বা রেশনের উপর বাঁচতে হয়েছিল। তাদের অনেকেই রোগে মারা যেত। জাহাজগুলি প্রায়ই ঝড়-ঝঞ্চার কবলে পড়ত, এবং কোন কোন জাহাজ হয়ত-বা সমুদ্রে তলিয়ে যেত।
আসামে প্রথম থেকেই বহু জাতি উপজাতি ও ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। এই সকল মানুষের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনৈতিক পটভূমি ও সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্য ও বর্তমান। আসাম প্রদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশকালে ইংরেজ শাসক তাঁদের মুনাফা অর্জনের প্রতি লক্ষ রেখেই বাংলার অন্তর্গত শ্রীহট্ট বা সিলেট এবং গোয়ালপাড়া জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করেন। এই দুটি জেলাতেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাছাড় জেলাতেও ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের বসবাস। আবার চা-বাগান সৃষ্টির সময়কাল থেকে আসামে বৈচিত্র্যময় মানুষের ভিড় আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসক এই স্বতন্ত্রতার বিষয়টি বিবেচনায় নেননি। ফলে, বৈচিত্র্যের মধ্যে একের অনুসন্ধান প্রয়াস ছিল দুশ্চেষ্টিত প্রায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিগত সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাঙালি অসমিয়া সংঘাত-সংঘর্ষ, হিংসা রক্তপাত ছিল এই স্বতন্ত্রতাকে কেন্দ্র করেই। আমরা এ কথা বলতেই পারি, এই বৈরিতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছিল একপক্ষীয় এবং তা মূলত অসমিয়া জাতির পক্ষ থেকে। এই পেশিশক্তি আরও সক্রিয় হয় সাতচল্লিশ উত্তরকালের শুরু থেকে। পুরোপুরি রাজশক্তির আর্শীবাদলাভও ঘটে এ সময় থেকেই।

১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পরপরই আসাম সরকার তাঁদের ভাষানীতি প্রকাশ্যে আনেন। আসামের প্রধানমন্ত্রী (এ সময় মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত) গোপীনাথ বরদলৈ ১৯৪৭ সালের ৩ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানান, Assamese would be the official and state language.’ তিনি আরও বলেন ‘Assamese would also be the medium of instruction in schools.”

১৯৪৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী বরদলৈ শিলচর আসেন আগরতলা স্টেটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। এ সময় স্থানীয় মানুষের দেওয়া স্মারকলিপির জবাবেও তিনি জানিয়ে দেন : Assamese as a state language would be made compulsory.’ সুতরাং, আসান সরকারের ভাষা নীতি সম্পর্কে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। দ্বিতীয় ভাষা বা অন্য কোনো ভাষার কথাও উচ্চারণ করেননি তিনি। সদ্য স্বাধীন ভারতের একটি প্রদেশ সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের সার্বিক নীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয় বলে মনে করার কারণ বর্তমান।…..

বইটি মোবাইলে পড়তে স্কেন করুন

আসামে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি-প্রসঙ্গ ১৯৪৭-১৯৬১